রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৬ অপরাহ্ন
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জের মাদানীনগর মাদরাসা সংলগ্ন অরুন মিয়া নামে এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাকিং, এ টুজেডসহ বিভিন্ন ব্যান্ডের কয়েল প্রস্তুত ও বিক্রি করে মাত্র কয়েক বছরে নয়াআটি এলাকায় একাধিক বহুতলাবিশিষ্ট বাড়ি ও জায়গা জমির মালিক হয়েছে। পকেটে ভরেছেন কোটি কোটি টাকাও। মাত্র কয়েক বছর পূর্বে যার নুন আনতে পান্তা ফুরাতো, কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন শুধুমাত্র কয়েলের ব্যবসা করে। অরুন মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, প্রশাসনসহ সকলকে ম্যানেজ করেই দির্ঘদিন ধরে এ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন।
মৌচাক শাপলা বেকারি এলাকা সংলগ্ন জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি বিভিন্ন ব্যান্ডের কয়েল তৈরি ও বিক্রি করে আসছেন। সিদ্ধিরগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় একাধিক কয়েল কারখানার মালিক তিনি। এ ব্যবসা করে তিনি অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেন, আমি কয়েল প্রস্তুত সমিতির সহ-সভাপতি সরকার যদি আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেয় তা হলে আমরা ব্যবসা ছেড়ে দিব। এ অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে কিভাবে ব্যবসা করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সারা দেশে অবৈধভাবে এ ব্যবসা চলছে, তাই আমরাও করছি।
মিজমিজি পাগলাবাড়ি এলাকায় মহিউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি প্রায় ১০ বছর ধরে এ ব্যবসা করে আসছেন। আবাসিক এলাকায় ও অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে এতদিন কিভাবে এ ব্যবসা পরিচালনা করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশাসন ও সকলকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা করতে হয়। অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে কিভাবে ব্যবসা করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ছয় মাস আগে তিতাস গ্যাসের লোকেরা আমার কারখানার গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পর আমি সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছি।
সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড বাজার সংলগ্ন এলাকায় ঢাকার নবীনগর এলাকার বাসিন্দা নুরুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি নাবিয়া গ্রুপ নামে মিজমিজি কান্দাপাড়া এলাকায় ও ডেমরার পাইটি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যবসা পরিচালনা করছেন। গত দুই মাস পূর্বে ওই কয়েল কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। ঘনবসাতিপূর্ণ এলাকায় কিভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবসা পরিচালনা করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে নুরুজ্জামান বলেন, সবকিছু সমাধান করেই আমাদের ব্যবসা করতে হয়। সেটাই আমরা করছি।
মিজমিজি কান্দাপাড়া এলাকায় মেহেদী এন্টারপ্রাইজ নামের সিক্সস্টার গোল্ড ব্যান্ডের নামে কয়েল তৈরি করছেন সোহরাব হোসেন ও তার ছয়জন বন্ধু। শাহজাহান কালু নামে এক ব্যক্তির টিনসেট বিল্ডিংয়ে আবাসিক গ্যাস সংযোগের একটি চুলা থাকলেও পুরো কারখানার কাজ করা হচ্ছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে। আবাসিক এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সোহরাব হোসেন জানান, বাড়ির মালিক আগে কয়েল তৈরির খারখানাটি ভাড়া নিয়ে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তার কাছ থেকে বাড়িটি ভাড়া নিয়ে আমরাও ঠিক একইভাবে ব্যবসা করছি।
মিজমিজি পশ্চিম পাড়া এলাকায় প্রিন্স নামের এক ব্যক্তি কুইন কিং কয়েল নামের একটি কারখানা চালিয়ে আসছেন। অভিযোগ ওঠেছে তিনি তার কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে প্রায় বার রকমের কয়েল বাজারজাত করে আসছেন। প্রতিবেশীরা জানান, প্রায় দশ বছর যাবৎ এই ব্যবসা করে তিনি বনে গেছেন কোটিপতি। প্রিন্সকে কারখানায় না পেয়ে তার ম্যানাজার রাশেদ মিয়ার সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমি এই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ম্যানাজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে আমি আরএস ব্রান্ড নামে একটি কয়েক বাজারজাত করে আসছি। কিভাবে করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রিন্স ভাইয়ের কারখানায় কয়েল তৈরি করে বাজারজাত করে আসছি। এছাড়া দেলোয়ার হোসেনের বাড়ি ভাড়া নিয়ে বজলুমিয়া নামে এক ব্যক্তি ইউনাইডেট ব্যান্ডের মশার কয়েল, মৌচাক ক্যানেলপাড় এলাকায় তোফাজ্জল হোসেন নামে এক ব্যক্তি অ্যাপেক্স বান্ডের কয়েল তৈরি করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
একই এলাকায় এটাক কিং নামের একটি কয়েল কারখানার মালিক রফিকুল ইসলাম নীয়মনীতি উপেক্ষা করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই যেভাবে করছে আমিও সেভাবেই ব্যবসা করছি। এভাবেই সিদ্ধিরগঞ্জের কান্দাপাড়া, সাহেব পাড়া, মৌচাক, মিজমিজি পশ্চিমপাড়া, বাতান পাড়া, পাগলাবাড়ি, সানারপাড় পুকুরপার, পাইনাদী শাপলাচত্তর, জালকুড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক মশার কয়েল তৈরির কারখানার মালিক অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, ওই সকল কয়েল তৈরির কারখানাগুলো বাহির থেকে তালা ঝুলিয়ে ভেতরে অপ্রাপ্ত ব্য়স্ক শ্রমিক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করছেন। তাদের বেশিরভাগ কারখানাই ফায়ারইকুপম্যান্ট দেখা যায়নি। একটি দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারেন কারখানার সকল শ্রমিক। অপরিচিত কোনো ব্যক্তিকে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ অভিযান চালানোর পর কয়েক মাস ব্যবসা বন্ধ করে কারখানাগুলো অনত্র স্থানান্তর করে পূর্বে ন্যায় এই অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এই অবৈধ ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ মালিকেরই পরিবেশের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। এক্ষেত্রে ম্যানেজ নামক শব্দটি তাদের প্রতিনিয়তই সহযোগীতা করছেন। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই ব্যবসা করার কারখানার আশেপাশের লোকজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। আর কারখানার মালিক রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, তিতাস গ্যাস অভিযান পরিচালনা করে জেল জরিমানা করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক পারে পুনরায় গ্যাস সংযোগ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন।
আবাসিক এলাকায় কয়েলকারখানায় পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাঈদ আনোয়ার কালের কণ্ঠকে জানান, আবাসিক এলাকায় কোনোভাবেই পরিবেশের ছাত্রপত্র দেওয়া হয় না। যদি কেউ পরিবেশের ছাড়পত্র পেয়েছে এমন বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মমিনুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, এরই মধ্যে আমরা অবৈধ কয়েক কারখানায় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। কয়েকজনকে জেল জরিমানা করা হয়েছে। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
আবাসিক এলাকায় ও অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক কয়েল কারখানা পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জসিম মিয়া কালের কণ্ঠকে জানান, এ সকল অবৈধ কয়েল কারখানার বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও মালিকদের জেল জরিমানা করা হয়েছে। অবৈধ ব্যবসায়ীদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।